মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার :
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। অভিভাবকরা নিজ সন্তানকে এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে উন্মুখ হয়ে থাকেন। এমন একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান অধ্যক্ষের সঙ্গে একজন অভিভাবকের ৪ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের একটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ড সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। আলোচ্য কথোপকথনটির শ্রোতারা এটি শোনার পর ছি ছি করেছেন।
কেউ অর্ধেক শুনে রাগে বা লজ্জায় এটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে অনেকে শিক্ষাঙ্গনের বাস্তবতা ও সরকারের নিয়োগপ্রক্রিয়ার ধরন অনুধাবনের জন্য অডিওটির সবটুকু শুনে স্তম্ভিত হয়েছেন। আবার কেউ ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, হায়! আমরা এমন শিক্ষকের কাছে সন্তানদের বিদ্যার্জনের জন্য পাঠাচ্ছি!
তারা ভাবতেই পারছেন না যে, একটি অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ এমন ভাষায় কথা বলতে পারেন। শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে লেখাপড়া ছাড়াও শালীনতা, শিষ্টাচার, বিনয়, ভদ্রতাসহ আরও অনেক কিছু শেখে। এজন্য বলা হয়, শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থীর ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।’ সংক্ষেপে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় আইকন।
ভিকারুননিসা স্কুলের অধ্যক্ষের বিষয়টিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। ভিকারুননিসার অধ্যক্ষের আচরণটি কোনো শিক্ষকের প্রথম অনৈতিক কাজ নয়। তার অডিওর বক্তব্য শালীনতার সীমা অতিক্রম করলেও অনৈতিকতার দিক দিয়ে এমন অডিও শিক্ষাঙ্গনে আগেও প্রকাশ পেয়েছে।
কয়েক বছর আগে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে জনৈক শিক্ষকের একটি অডিও প্রচার পেলে গণমাধ্যম ‘থ্রি ফার্স্ট ক্লাসে ১৫ লাখ টাকা, ফোরে ১২’ শীর্ষক সংবাদ শিরোনাম করেছিল (যুগান্তর, ০২-০৪-২০১৭)। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা দুর্নীতি, যৌন অপরাধ, একাডেমিক দুর্নীতি, যৌথ নামে প্রকাশিত গবেষণা একক নামে প্রকাশ, অন্যের গবেষণা প্রবন্ধ বা থিসিস লিখে দেওয়া, সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষা না নেওয়া, প্লেজিয়ারিজমসহ নানাবিধ অপরাধে জড়িত হয়েছেন। শিক্ষাঙ্গনের সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
আসলে শিক্ষাঙ্গন কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজে যদি নিয়ম-শৃঙ্খলা, গণতন্ত্রচর্চা, শিষ্টাচার ও সহমর্মিতার পরিবেশ না থাকে, তাহলে পৃথকভাবে শিক্ষাঙ্গনে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এক স্কুলশিক্ষকের অবৈধ যৌন সম্পর্কের কথা স্মর্তব্য। ওই শিক্ষকের শাস্তি হলেও তার মতো অনেকে যে এখনো শিক্ষাঙ্গনে আছেন, এর উদাহরণ ‘শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী লাঞ্ছিত’, ‘সোনাগাজীতে বলাৎকারের শিকার মাদ্রাসা ছাত্র’ ইত্যাদি সংবাদ মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
ভিকারুননিসা স্কুলের অধ্যক্ষকে নিয়ে চলমান আলোচনাটা এ লাইনে নয়। কী আছে অধ্যক্ষের বক্তব্যে যা নিয়ে এত আলোচনা ও ছি ছি উচ্চারিত হচ্ছে? আলোচ্য সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে অধ্যক্ষ চূড়ান্তভাবে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করেছেন। বক্তার পরিচয় না জানা শ্রোতার কাছে বক্তাকে অধ্যক্ষের পরিবর্তে পেশাদার মাস্তান বা গুণ্ডা মনে হবে। কারণ ওই কথোপকথনে দাও দিয়ে কোপানোর কথা, পিস্তল দিয়ে গুলি করার কথা, পিস্তল বালিশের নিচে রেখে ঘুমানোর কথা, রাস্তার মধ্যে কাপড় খুলে পেটানোর হুমকি, নিজের শক্তিমত্তার কথাসহ অশ্রাব্য ভাষার গালাগাল রয়েছে, যার সামান্য ইঙ্গিত এ লেখায় দেওয়া হয়েছে।
একজন অধ্যক্ষের মুখের ভাষা যদি এমন হয়, তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে কী শিখবেন? ভিকারুননিসার অধ্যক্ষের বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসগঠনে নিঃসন্দেহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমন অধ্যক্ষ কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। যোগ্য পদে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ না দিলে যে তার পরিণতি এমন হয়, সংশ্লিষ্টদের তা অনুধাবন করতে হবে।
এবার শিক্ষার মানের দিকে আসা যাক। এক যুগেরও বেশি সময় বর্তমান সরকার ক্ষমতায়। এ সময় শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কার্নিশে উপনীত হয়েছে। নিম্ন পর্যায়ে শিক্ষা নিয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তা সফল হয়নি। দশম সংসদ নির্বাচনের পর প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ওই সময় পিইসি, জেএসসি, এইচএসসি, অনার্স প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। উল্লেখ্য, এখানে বিসিএস এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা না বলে কেবল শিক্ষাঙ্গনের প্রশ্নফাঁসের কথা বলা হচ্ছে।
স্মর্তব্য, মধ্য-২০১০ সালে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। দুষ্কৃতকারীরা প্রতি চাকরিপ্রার্থীর কাছে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকায় এ প্রশ্ন বিক্রি করে। রংপুর পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত ১৬৭ জনকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে ৬৮ লাখ টাকা উদ্ধার করে (শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভাবনা, চট্টগ্রাম, খড়িমাটি, ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৯৬)। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ১৭ জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে বাতিল হয়।
ওই পরীক্ষা পুনরায় অনুষ্ঠানের সময় কতিপয় জেলায় আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। লালমনিরহাটে এমন স্থগিত শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে ডিবি পুলিশ ওই কুকর্মে জড়িত ছয় নারীসহ ৩০ জনকে আটক করে। তবে প্রতিটি প্রশ্নফাঁস ঘটনার পর গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং চিরাচরিত ভঙ্গিমায় তা ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে যায়। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং এর সংশোধনী ১৯৯২-এ প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ কাজে জড়িতদের ৩ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান থাকলেও আইন প্রয়োগে শিথিলতার কারণে এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ বিরল।
প্রশ্নফাঁসের পরীক্ষায় ভালো ফল করা শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রীরা কেমন শিক্ষা পাবে? কেমন হবে তাদের পরীক্ষার ফলাফল? ২০১৪-১৫ সালের দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে উদার নীতি অবলম্বন করলে স্কুল পর্যায়ে জিপিএ ফাইভের বন্যা বয়ে যায়। তখন থেকে স্কুলের পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীরাও বোর্ডের পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেতে থাকে। এ কারণে জিপিএ ফাইভের ওজন কমে যাওয়ায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মন ভেঙে যায়। অভিভাবকরাও এমন ফলাফলে খুশি হননি। ওই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর বেশি খুশি ছিলেন দেশের মিষ্টির দোকানদাররা।
কারণ এমন ভালো রেজাল্টের বন্যায় শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত মান অর্জন করতে না পারলেও ফল ঘোষণার দিন মিষ্টির কেনাবেচা ভালো হয়। শিক্ষার্থীদের মান অনুধাবনে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বিশেষ দূত জেনারেল এরশাদের বক্তব্য বিবেচনাযোগ্য। তিনি বলেন, ‘যে শিক্ষার্থীর শূন্য নম্বর পাওয়ার কথা, তাকে শুধু পাস নম্বর নয়, জিপিএ-৫ দেওয়া হচ্ছে। এখানে শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ নেই। এর জন্য দায়ী শিক্ষক ও বড় বড় কর্তারা। তাদের বলে দেওয়া হয়, সবাইকে পাশ করা দেখাতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২১-০৩-২০১৭)।
শিক্ষার্থীরা যে তখন প্রত্যাশিত মান অর্জন করছিল না, সে বিষয়টি ২০১৬ সালে মাছরাঙা টিভির এক প্রতিবেদনেও তুলে ধরা হয়। ওই বছরের মে মাসে মাছরাঙা টিভির একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের বিষয়টি নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। ওই সাক্ষাৎকারে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া কতিপয় শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করে তাদের মান যাচাই করা হয়। সাক্ষাৎকারটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুশীল সমাজ হতাশ হয়ে পড়ে। সাক্ষাৎকারে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ‘জিপিএ’ ও ‘এসএসসি’র পূর্ণ রূপ বলতে পারেনি। ‘আমি জিপিএ-ফাইভ পেয়েছি’- এর ইংরেজি করেছে : ‘আই অ্যাম জিপিএ-ফাইভ’।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে পালিত হয় তাও তারা বলতে পারেনি। জাতীয় স্মৃতিসৌধ কোথায় তাও জানে না তারা। পিথাগোরাসকে ঔপন্যাসিক এবং জাতীয় সংগীত রচয়িতার নাম বলেছে কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের পাঠক দাবিদার একজন শিক্ষার্থী রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি গল্পেরও নাম জানে না। কম্পিউটার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী এক শিক্ষার্থী হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার কী তা জানে না।
বিজ্ঞান পড়া ছাত্র জানে না নিউটনের সূত্র। আরেক শিক্ষার্থী জানে না বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির নাম। জিপিএ-৫ পাওয়া সব শিক্ষার্থীর মানই যে এমন তা বলছি না। তবে এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় শিক্ষার গুণগত মান কমেছে। এজন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের দায় বেশি।
আমরা একটি খ্যাতনামা স্কুলের অধ্যক্ষের আলোচ্য ফোনালাপের ভাষার তীব্র সমালোচনা করব অবশ্যই। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা এমন প্রতিষ্ঠানপ্রধান চাইব, যার প্রতিটি কাজ, আচরণ ও কথা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিখবেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনে তাকে অনুকরণীয় আইকন হিসাবে শ্রদ্ধা করবেন।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়